অ-সম
– শিলাবৃষ্টি
সাম্যের শুরুটা হোক ছোট থেকেই। নাহলে আরো অনেক অনেক যুগ ধরে মেয়েদের কন্যা হয়ে জন্মগ্রহণের নতি স্বীকার করে যেতে হবে।
” কি হয়েছে? মেয়ে?” ঠাকুমার এই ভ্রু কোঁচকানো, বাবার মুখাবয়বে নৈরাশ্য – কেন?
কতদিন চলবে এই বৈষম্য জানি না!
আজ আমি মিতালী বসু অনেক স্বপ্ন চোখে এঁকে ডাক্তারি পড়তে ঢুকেছি, অবসর নেই বললেই চলে! তবু মনে এসে ভিড় করে হাজার কথা। আজ বিশ্ব নারী দিবসে উদাসী মন ফিরে ফিরে যায় শৈশব থেকে মেয়েবেলায়।
বাবারা দু’ভাই, জ্যেঠু, জ্যেঠিমা, বাবা, মা, ঠাকুমা আর এক বিধবা পিসিমাকে নিয়ে ছিল আমাদের বসু পরিবার। জ্যেঠিমা যখন মা হতে চলেছে বাড়িতে স্বাভাবিক ভাবেই আনন্দ এসে দেখা দিয়েছে। সকলের সাবধানতায়, যত্নআত্তিতে দশ মাস কেটে যাওয়ার পর যখন হাসপাতাল থেকে জ্যেঠু জানিয়েছে জ্যেঠিমার পুত্র সন্তান হয়েছে, তখন ঠাকুমা ঠাকুরঘরে ছুটে গিয়ে প্রণাম করেছে। পিসিমা শাঁখ বাজিয়ে মঙ্গল ঘোষণা করেছে, আশা পূর্ণ হয়েছে বলে ঘটা করে নারায়ণ পুজো করা হয়েছে বাড়িতে। পাড়ায় মিষ্টি বিতরণও বাকি থাকেনি। আর জ্যেঠিমার আদর এ বাড়িতে অনেক গুণে বেড়ে গেছে।
এর দুবছর পরে আমার মা সন্তানসম্ভবা যখন হয়েছিল, তখন একই ভাবে মায়ের খেয়াল রাখা হলেও মেয়ে হওয়ার পরে মানে আমি হওয়ার পরে বাড়ির মানুষের চেহারাগুলো কেমন পাল্টে যায়। না – শঙ্খ বাজেনি ঘরে। পাড়ার লোকের মুখ মিষ্টি করাও হয়নি। বাবার মুখেও শুনেছি হাসি ছিল না।
তবে জ্যেঠিমা আমাকে বরণ করে ঘরে ঢুকিয়েছিল। জ্যেঠু কোলে তুলে নিয়েছিল। আমার তিন বছরের দাদাভাই বোনকেই তার খেলার পুতুল ভেবে নিয়েছিল।
ঠাকুমা পিসিমার কাছে উঠতে বসতে মাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছিল। মায়ের চোখের জল সেদিনগুলোয় বাবাও মুছে দিতে আসেনি।…..
ছোটবেলা থেকেই আমি লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিলাম। সে তুলনায় দাদা সেরকম রেজাল্ট করতো না। জ্যেঠু জ্যেঠিমা দাদাকে খুব বকাবকি করতো। কিন্তু দাদা কেয়ার করতোই না। কারণটা হয়তো ঠাকুমা পিসিমার আস্কারা।
কিছু কিছু অনুভূতি আজো বেদনাদায়ক!
সাত সকালে দুই ভাইবোনকে মুড়ি আর রসগোল্লা দিয়ে বসিয়ে দিয়েছে পিসিমা। দাদা আরেকটা মিষ্টি চাইলো, সাথে সাথে পেয়ে গেল। আমি করুণ চোখে তাকিয়ে থাকতাম কিন্তু পেতাম না। ঠাকুমা প্রতিমাসে তার পেনসেনের টাকা থেকে লুকিয়ে দাদার হাতে দু’শ টাকা দিত। আমি সামনে এসে গেলেও কোনোদিন দেয়নি। অথচ ঠাকুমার প্রতি ভালোবাসা আমার কমেনি কখনো।
একবার দোলের সময় পিচকিরি এলো, বাবাই এনেছিল। দাদার পিচকিরিটা খুব সুন্দর দেখতে বড়। আর আমারটা একদম ভালো ছিল না। খুব কেঁদেছিলাম সেদিন। তাতে ভাগ্যে সবার বকুনিই জুটেছিল। দাদা কিন্তু বুঝতে শিখেছিল তখন অনেকটাই। তাই সেদিন তার ভালো পিচকিরিটা আমায় দিয়ে দিয়েছিল। বেশ জোর গলায় বলেছিল “একরকম পিচকিরি আনতে পারলে না কাকু?”
এভাবেই মানুষ হলাম। দাদা গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে জ্যেঠুর ব্যবাসার দেখাশোনা করে এখন। আমি মায়ের ইচ্ছেপূরণের লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছি। আজ ঠাকুমার মুখে আমার জন্য খুশীর হাসি দেখেছি। আমিই এখন ঠাকুমার শারীরিক সুস্থতার দেখাশোনা করি। পিসিমা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে। বাবা বুঝেছে মেয়েরাও কোনো অংশে কম নয়। আর জ্যেঠু জ্যেঠিমা দাদাভাই-এর আদর ভালোবাসা আমার জীবনের পাথেয়। মা আমার আদর্শ।